- - https://dailyjogajog.com -

শেরপুরের বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায়ে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ

শেরপুরের বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও দপ্তর গুলোর অনীহার কারনে সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা বিল আদায়ের সামগ্রিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছেনা। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ও দপ্তর দীর্ঘ দিন ধরে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রাখছে। বকেয়া বিল আদায়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।

ফলে বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত বোর্ড-কোম্পানিগুলো গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে নতুন ভাবে গতি সৃষ্টি করতে পারছে না, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গতি হারাচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে ৬টি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ বিতরণ করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) এবং নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)। এসব কোম্পানির মধ্যে শেরপুর জেলার সকল উপজেলায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।

শেরপুর পিডিবি অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসকের দপ্তরের প্রায় ১০ লক্ষ, জেলা হাসপাতালের কাছে ২৪ লক্ষ, শেরপুর পৌরসভার ৪৪ লক্ষ, শেরপুর স্টেডিয়ামের ১০ লক্ষ, শেরপুর সদর মডেল মসজিদে সাড়ে ৩ লক্ষাধিক, নালিতাবাড়ী পৌরসভার কাছে ৫৪ লক্ষ, যুগানিয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় এক লক্ষ, নালিতাবাড়ী মডেল মসজিদে আড়াই লক্ষাধিক, গোসাইপুর ইউনিয়ন ও নন্নী ইউনিয়ন পরিষদে দেড় লক্ষাধিক করে, ঝিনাইগতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দেড় লক্ষ, নকলা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে ৩ লক্ষাধিক, উপজেলা কৃষি অফিসের ৩ লক্ষাধিক, উপজেলা ভ‚মি অফিস তথা সহকারী কমিশনার এর কার্যালয়ের কাছে লক্ষাধিক টাকা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রায় এক লক্ষা টাকা এবং বানেশ্বরদী ইউনিয়ন পরিষদের কাছে ৪২ হাজার টাকা বকেয়া রয়েছে।

এবষিয়ে বানেশ্বরদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাজহারুল আনোয়ার মহব্বত বলেন, আমার দপ্তরের কাছে বিদ্যুৎ বিভাগের কোন বকেয়া নেই। আমি গত বছর কয়েক ধাপে প্রায় পৌণে একলক্ষ টাকা বিল পরিশোধ করে প্রিপেইড মিটার লাগিয়েছি। আমার দপ্তরের কাছে বিদ্যুৎ বিভাগের বকেয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। বরং সরকার কর্তৃক সরবরাহ করা আমার পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনে ব্রডব্যান্ড লাইনের সেফটিনেট কক্ষে সবসময় চলমান বৈদিুতিক পাখা, আইপিএস ও শক্তিসালী মেশিন থাকায় বিদ্যুৎ বিল বেশি হয়। তাদের বিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা অফিস পরিশোধ করার কথা থাকলেও তারা পরিশোধ করছেনা। তাই বাধ্য হয়ে নিজের ইউপির সুনাম রক্ষায় আমার দপ্তর থেকেই পরিশোধ করে আসছি। তিনি আরো জানান, উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে একমাত্র বানেশ্বরদী ইউনিয়ন পরিষদের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা এবং প্রথম প্রিপেইড মিটার লাগানো হয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ শাহরিয়ার মোরসালিন মেহেদী বলেন, ‘আমি নকলায় যোগদানের আগে উপজেলা কৃষি অফিসসহ উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনের সকল দপ্তরের বিদ্যুৎ লাইন উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যালয়ের লাইন থেকে নেওয়া ছিলো। ফলে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে সকল দপ্তরের মধ্যে যথাসময়ে আলোচনা না হওয়ায় হয়তোবা বকেয়া হয়েছিলো। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া উম্মুল বানিন-এঁর একান্ত প্রচেষ্ঠায় সকল দপ্তরের বিদ্যুৎ লাইন আলাদা করা হয়েছে। বর্তমানে কোন দপ্তরের নতুন করে বকেয়া হচ্ছে না বলে তিনি জানান।

নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, আমার তত্বাবধানের নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাছে কোন বিল বকেয়া নেই। তবে কিছু বিল বাকি ছিলো তা আবাসিক ভবনের বসবাসকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে। ওইসব আবাসিক ভবনের বকেয়াও পরিশোধ করানো হয়েছে।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মানিক দত্ত জানান, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ হতে ৫ লক্ষ ৮০০ টাকা জেলা ক্রীড়া সংস্থার জন্য বার্ষিক আর্থিক বরাদ্দ দেওয়া হয়; যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এই টাকা দিয়ে খেলার আয়োজন, জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে খেলায় অংশ গ্রহন করা, জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতাদি, বিদ্যুৎ বিল, পৌরকর, ভুমি উন্নয়ন কর, ক্রীড়া সামগ্রী ক্রয় ও রক্ষনাবেক্ষণসহ সবকিছু মিটাতে হয়। কাঁচাবাজারের ইজারা ও বাসের আয় ছাড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার অন্যকোন আয়ের উৎস নেই বললেই চলে। কাঁচাবাজারের জায়গা পৌরসভায় ইজারা দেয়া হয়েছে। গত বছর ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাাক ছিলো, তবে চলতি বছর প্রায় ৩ লক্ষ টাকার মত পাওয়া যাবে। এসব দিয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যয় বহন করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রায় পৌণে ৫ লাখ টাকার মত পরিশোধ করেছেন। তিনি আরো জানান, গত মাসে তথা জুন মাসেও এক লক্ষ টাকা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হয়েছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বা সরকারি ভাবে বরাদ্দ বাড়ানো বা জেলা ক্রীড়া সংস্থার নিজস্ব আয়ের পথ না হলে বকেয়াগুলো পরিশোধ করা কঠিন। তবুও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তাগন সদা তৎপর রয়েছেন বলে তিনি জানান।

এবিষয়ে নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া উম্মুল বানিন বলেন, ‘আমি নকলায় যোগদানের আগে থেকেই বিদ্যুতের এই তিন লক্ষ্য টাকা বকেয়া রয়েছে। নতুন উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনে আমার কার্যালয়সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর রয়েছে। সেকল দপ্তরের বিদ্যুৎ সংযোগ আমার অফিস থেকে নেওয়া হয়েছে। এজন্যই হয়তোবা সকল দপ্তরের সাথে বিল সমন্বয়ের সময়ের অভাবে বিল বেশি বকেয়া রয়েছে। নতুবা এতো বিল বকেয়া থাকার কথা নয়।’ তিনি জানান, উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনের সকল দপ্তর প্রধানের সাথে বসে আলোচনা করে বকেয়া পরিশোধের প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় একলক্ষ্য টাকা বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হয়েছে। সম্প্রতি সকল দপ্তরকে নিজস্ব মিটার দিয়ে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে এবং সেসকল দপ্তর সমূহ নিয়মিত বিল পরিশোধ করে আসেছে বলেও ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিন জানান।

সূত্র জানায়, ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোর মোট বকেয়ার পরিমাণ বেশি হলেও তারা অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করে। ফলে তা বিতরণ কোম্পানিগুলোর ওপর বেশি চাপ তৈরি করছে না। কিন্তু অনেক সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরে বিল দিচ্ছে না। ফলে কোম্পানিগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। বকেয়া বিল দেশের বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা। স্মার্ট ও প্রিপেইড মিটার পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা গেলে বকেয়া নিয়ে অস্বস্থিকর চাপ দূর হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগন। বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রিপেইড মিটার স্থাপনে অনেকগুলো প্রকল্প চলমান রয়েছে। তাছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন দ্রুত বিল পরিশোধ করে সেজন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বর্তমান পরিস্থিতি আগের চেয়ে বেশ ভালো হয়েছে। তবে আরো ভালো হওয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক গ্রাহক জানান, ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও দপ্তর গুলোর গাফলতির কারনে সাধারণ জনগনকে সেবা প্রাপ্তিতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। কারন হিসেবে জানান, তাদের বিল বকেয়া থাকায় স্বাভাবিক কারনেই বিদ্যুৎ বিভাগ সেবার মান বাড়াতে পারছেনা। তাছাড়া সাধারণ গ্রহকদের বিল ২/৩ মাস বকেয় হলেই লাইন কেটে দিয়ে বিভিন্ন ভাবে হয়রানিতে ফেলা হয়। অথচ, ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও দপ্তর গুলোর বিদ্যুৎ বিল বছরের পর বছর বাকি! এটা দেখার যেন কেউ নেই। এমন অনেক অভিযোগ রয়েছে তাদের।