- - https://dailyjogajog.com -

সংকট কাটেনি জ্বালানি–ডলারের, বেড়েছে লোডশেডিং

বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। বৈদেশিক মুদ্রা ডলার জোগাড় করতে না পারায় বিল বকেয়া বাড়ছে। এর ফলে গরম বাড়লেই চাপে পড়ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না তারা। জ্বালানি ও ডলারের সংকটে লোডশেডিং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। বৃষ্টি হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

বিদ্যুৎ সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সোমবার রাতে আড়াই হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে। গ্যাস সরবরাহ বাড়েনি। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও কম সরবরাহ হচ্ছে। এর মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব ইউনিট। এতে গতকাল মঙ্গলবার তিন হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে লোডশেডিং।

দেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট। প্রয়োজনের সময় আগে সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এখন ৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা যাচ্ছে না। পিডিবি বলছে, দিনে ১২০ থেকে ১৩০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে বিদ্যুৎ খাত। এখন সরবরাহ হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ কোটি ঘনফুট।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে দিনে গ্যাস আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এতে এখন সরবরাহ হচ্ছে ৬০ কোটি ঘনফুট। ১২ সেপ্টেম্বর টার্মিনাল চালু হতে পারে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, সামিটের টার্মিনাল চালুর পর মজুত থাকা গ্যাস থেকে কিছু সরবরাহ করা যাবে। খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। দরপত্র আহ্বান করে প্রক্রিয়া শেষ করতে একটু সময় লাগতে পারে।

একক বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ভারতের ঝাড়খন্ডে নির্মিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র। দিনে দেড় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে তারা। তারা এখন সরবরাহ করছে এক হাজার মেগাওয়াট।

পিডিবি ও আদানির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, লোডশেডিং কমাতে পাওনা পরিশোধে সোনালী ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত সোমবার ৮০ লাখ ডলার ও গতকাল ২০ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। আজ বুধবার আরও কিছু পরিশোধ করার কথা রয়েছে। তবে বকেয়ার তুলনায় এটা তেমন কিছুই না। দিনে ৩০ লাখ ডলার পাওনা হয় আদানির। তাই তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে রাজি হচ্ছে না। আরও কিছু বিল পরিশোধ করা হলে সরবরাহ বাড়তে পারে।

ব্যাংক থেকে বন্ড ছেড়ে বেসরকারি খাতের বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের চাপ কিছুটা কমিয়েছিল গত আওয়ামী লীগ সরকার। তবুও বকেয়া জমে ছিল। গ্যাসের বিল, সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল, ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল মিলে পিডিবির বকেয়া এখন ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বকেয়ার চাপ থাকায় বেসরকারি খাতের তেলচালিত কেন্দ্রগুলো থেকেও সর্বোচ্চ চাহিদায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এর বাইরে বিলম্বে বিল পরিশোধের জরিমানা হিসেবে ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ২৭ লাখ ডলার, যা প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এটি নিয়ে কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, গ্যাসের সরবরাহ বাড়ছে না। চাহিদামতো ডলারও পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে গরম বেড়ে যাওয়ায় একটু বিদ্যুৎ ঘাটতি হচ্ছে। তেলচালিত কেন্দ্র থেকে উৎপাদন বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি অনেক বেশি হলে রাজধানী ঢাকাতেও লোডশেডিং করতে হয়। ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। এ দুটি সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ঢাকায় আগের দিনের চেয়ে লোডশেডিং বেড়েছে গতকাল। দুটি সংস্থা সোমবার দিনের বেলায় সর্বোচ্চ ১০০ মেগাওয়াট করে ঘাটতি পেয়েছিল। রাতে ডিপিডিসির ঘাটতি ২০০ মেগাওয়াট ছাড়ায়। গতকাল দিনেও ডেসকো এলাকায় ১৬০ মেগাওয়াট ও ডিপিডিসি এলাকায় ২০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। এতে করে রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় এক ঘণ্টা, কোথাও দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিং হয়েছে।

ঢাকার বাইরে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শহর এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে। তবে বেশি হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। ছয়টি বিতরণ সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি)। এ সংস্থাটির তথ্য বলছে, গতকাল দিনের বেলায় তিনটার দিকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪৭০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে তারা। ঢাকার আশপাশের এলাকাতে ৩৮ শতাংশ ঘাটতি ছিল তাদের। কুমিল্লায় ৩৭ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৩৫ শতাংশ, রাজশাহীতে ৩৩ শতাংশ, সিলেটে ২৮ শতাংশ, রংপুরে ২৬ শতাংশ বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল আরইবির।

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। গত সোমবার সকাল নয়টার দিকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তৃতীয় ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে থেকে অন্য দুই ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্কারের জন্য বন্ধ আছে। এই প্রথম বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটির তিনটি ইউনিটই বন্ধ হয়েছে। ফলে পার্বতীপুর উপজেলাসহ উত্তরাঞ্চলের আট জেলা ব্যাপকভাবে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে।

রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ-১-এর আওতাধীন মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, এমনিতেই প্রচণ্ড গরম। আধা ঘণ্টা থাকলে দুই ঘণ্টা থাকে না বিদ্যুৎ। দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টায় হয়তো ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর আওতাধীন গঙ্গাচড়া উপজেলার নবনিদাস এলাকার কৃষক সাদেকুল ইসলাম বলেন, দিনে-রাতে ৫-৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। ওই সমিতির মহাব্যবস্থাপক খুরশিদ আলম বলেন, ‘ফোনে মানুষের কষ্টের কথা শুনতে হচ্ছে। আমার বাড়িতেও তো বিদ্যুৎ থাকছে না।’

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে গতকাল বিকেলে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বৈঠক করেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একটি প্রতিনিধিদল।

বৈঠক সূত্র বলছে, তিনটি বিষয় গুরুত্ব দিয়েছে ক্যাব। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব কোম্পানির বোর্ড থেকে আমলাদের সরিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির মাধ্যমে সদস্য নিয়োগ দিতে হবে। প্রবিধানমালার মাধ্যমে সব কাজ বিইআরসি করবে। মুনাফা ও লুণ্ঠনমুক্ত বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত তৈরির নীতি নিয়ে সরকারকে এগোতে হবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে খরচ কমানোর কিছু পরামর্শ দিয়েছে তারা। চলমান লোডশেডিং পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে বৈঠকে।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, অন্য খাতে কমিয়ে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়ে, তেলচালিত কেন্দ্র বেশি চালিয়ে, ডলার জোগাড় করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ উৎপাদন বাড়ানো হলেই লোডশেডিংয়ের চলমান সংকট মোকাবিলা করা যাবে।